ঢাকা, বাংলাদেশ মঙ্গলবার ৯ই সেপ্টেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ আর্কাইভ
হোম  »  সম্পাদকীয়

মিডিয়া ট্রায়াল ও ফেসবুকের ভাইরাল পোস্ট: ন্যায়বিচার নাকি সামাজিক নৃশংসতা?

 দৈনিক সংকেত ডেস্কঃ 
একটি ছোট ভিডিও ক্লিপ। একটি অস্পষ্ট অডিও। কিংবা কারও বিরুদ্ধে লেখা একটি অভিযোগপত্র। তাৎক্ষণিকভাবে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করা হলো। মুহূর্তেই ভাইরাল—হাজার হাজার শেয়ার, শত শত মন্তব্য, গালিগালাজ, অপমান, ট্রল। এরপর সেই মানুষটির আর কোনো নাম নেই, পরিচয় নেই- সে শুধুই ‘অপরাধী’। যেন আদালতের রায় ছাড়াই সমাজ তাকে দোষী সাব্যস্ত করেছে।
এটাই আজকের ‘মিডিয়া ট্রায়াল’- যেখানে সত্য-মিথ্যার যাচাই না করেই, মানুষের জীবন নিয়ে খেলা হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
আমরা এমন এক সময় পার করছি, যেখানে একটি মোবাইল ফোন আর ইন্টারনেট সংযোগ মানেই ‘মিডিয়া’। তথ্য এখন সকলের হাতের মুঠোয়, কিন্তু সেই তথ্যের যথার্থতা কতটা আমরা যাচাই করি?
সোশ্যাল মিডিয়া অনেক সময় ক্ষমতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে- এ সত্য। কিন্তু সেই হাতিয়ার যদি নিয়ন্ত্রণহীন হয়, তবে তা অন্যায়কে প্রতিহত করার বদলে অন্যায় করবেই।
আমরা ভুলে যাই, একটি ভাইরাল ভিডিওর পেছনের মানুষটিও একজন বাবা হতে পারে, মেয়ে হতে পারে, কোনো মা হতে পারে- যার জীবনের গতি এক নিমিষে থেমে যেতে পারে জনতার অবিচারিক রায়ের সামনে।
আমরা প্রায়ই শুনি- “ভিডিওটাতে তো সব স্পষ্ট”, “লোকটা তো হাতেনাতে ধরা পড়েছে”, কিংবা “এত মানুষ বলছে—অবশ্যই অপরাধী”। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই “অবশ্যই” কে নির্ধারণ করছে?
আইনের চোখে অপরাধ প্রমাণিত হতে হলে চাই নিরপেক্ষ তদন্ত, সাক্ষ্যপ্রমাণ, বিচারপ্রক্রিয়া। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় এই প্রক্রিয়া নেই। সেখানে যে আগে পোস্ট করে, সে-ই ‘সত্য’ বলে বিবেচিত হয়। আর যে বেশি গলা তোলে, সে-ই ‘ন্যায়বিচারক’।
এই বিচারের নাম “মিডিয়া ট্রায়াল”- যা বাস্তবে অনেক সময় একপ্রকার ডিজিটাল লিঞ্চিং। যেন আমরা সবাই সোশ্যাল মিডিয়ায় দাঁড়িয়ে বিচার করছি, এবং সেই ‘অপরাধী’র জন্য সমাজে কোনো স্থান রাখছি না।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রাম, ঢাকা, খুলনা- সব জায়গাতেই এমন অসংখ্য ঘটনা আছে, যেখানে ভিডিও ভাইরালের লজ্জায় মানুষ আত্মহত্যা করেছে, অনেকে সমাজচ্যুত হয়েছে, অনেকে মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছে।
একজন মানুষ যদি অপরাধ করেও থাকে, সেটি বিচার করবে আদালত। আমরা বিচারকের আসনে বসে গেলে আইনের প্রয়োজনই আর থাকবে না। আর যদি নির্দোষ হয়- তবে আমরা সবাই মিলে একটি নিরীহ জীবন ধ্বংস করলাম না?
আমরা কী তাহলে চুপ থাকব? না, অবশ্যই না। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা নাগরিক দায়িত্ব। কিন্তু সেই প্রতিবাদ যেন হয় তথ্যনির্ভর, মানবিক, এবং আইনের পথে।
সোশ্যাল মিডিয়া হোক সত্য বলার প্ল্যাটফর্ম, প্রতিশোধ নয়। বিচার হোক আদালতে, রায় হোক সাক্ষ্য-প্রমাণে- not সোসাল মিডিয়া বা ফেসবুক স্ট্যাটাসের কমেন্টে।
আমরা সবাই কখনো না কখনো ভুল তথ্য শেয়ার করেছি। হয়তো আবেগে, হয়তো চাপের মুখে, কিংবা না বুঝে। কিন্তু এখন সময় এসেছে দায়িত্ব নিয়ে ব্যবহার করার- ভাইরাল কিছু দেখলে, প্রথমে যাচাই করি, শেয়ার করার আগে একবার ভাবি: এতে কারও ক্ষতি হচ্ছে কি না এবং নিজে আইন মানি, অন্যকে আইন মানার আহ্বান জানাই
এবং ভুল করলে স্বীকার করি- এই শিক্ষাটাও জরুরি।
আজ যে ভাইরাল, সে যদি কাল নির্দোষ প্রমাণিত হয়, তখন আপনি কী করবেন? আপনার দেওয়া ট্রল, কটূক্তি, ‘অপরাধী’ তকমা কি ফিরিয়ে আনতে পারবে তার ইজ্জত, তার জীবন, তার আত্মবিশ্বাস?
সোশ্যাল মিডিয়া হোক মানবতার হাতিয়ার—দমন, অপমান ও নিঃশেষ করার অস্ত্র নয়।
প্রসঙ্গত ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরাইল উপজেলার শাহবাজপুর ইউনিয়ন হাবলি পাড়ার মায়মুনা আক্তার ময়না হত্যাকান্ড।